
ডেস্ক রিপোর্ট:
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যেও মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ২২ জন উপদেষ্টার বেশিরভাগই একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের পক্ষে মত দিলেও সোমবারের বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টা সেই অবস্থান থেকে সরে আসেন।
তিনজন উপদেষ্টা জানান, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা থাকলে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করা সম্ভব। তাদের মতে, গণভোট ছাড়া সংস্কারের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, বিশেষ করে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনে পিআর (Proportional Representation) পদ্ধতি চালু করার বিষয়টি নির্ধারণে গণভোট প্রয়োজন।
বৈঠক শেষে এক উপদেষ্টা বলেন, “বেশিরভাগই নির্বাচনের দিনেই গণভোট চান, তবে কয়েকজন আগেই করার পক্ষে।”
ঐকমত্য কমিশনের প্রথম খসড়া অনুযায়ী, নতুন সংসদ গঠনের পর ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার না হলে খসড়া বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাস হবে। গণভোট হবে ওই খসড়া বিল ও আদেশের ওপর। সোমবারের বৈঠকে কিছু উপদেষ্টা দ্বিতীয় খসড়ার পক্ষে মত দেন, যেখানে জুলাই সনদ অনুযায়ী সংস্কারকে নির্দেশনামূলক রাখা হয়েছে।
বিএনপি এই আদেশ জারির বিরোধিতা করছে। অপরদিকে জামায়াত ও এনসিপি প্রথম খসড়ার ধারাবাহিকতায় বাধ্যতামূলক সংস্কার চায়। তারা রাষ্ট্রপতির বদলে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের মাধ্যমে আদেশ জারির দাবি জানায়। এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
বৈঠক শেষে জানানো হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধে সরকার কোনো মধ্যস্থতা করবে না। দলগুলো নিজেদের উদ্যোগে সমঝোতার পথ খুঁজে বের করবে। এক সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে না পারলে সরকার নিজস্বভাবে সিদ্ধান্ত নেবে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠক শেষে দুজন উপদেষ্টা জানান, সমঝোতার জন্য সাত দিনের সময় দেওয়া হয়েছে পরিষদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে।
তারা বলেন, “বৃহস্পতিবারের বৈঠকে অধিকাংশ উপদেষ্টা একই দিনে ভোটের পক্ষে থাকলেও, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে আলোচনায় আপস হয়নি। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির বিষয়ে ভিন্নমত প্রত্যাহারে রাজি হয়নি, জামায়াতও এখনো প্রকাশ্যে অবস্থান শিথিল করেনি।”
জামায়াতসহ আটদলীয় জোট এই এক সপ্তাহের সময়কে স্বাগত জানালেও তারা প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি মধ্যস্থতার দাবি জানিয়েছে। এনসিপি অভিযোগ করেছে, সরকারের একটি অংশ ঐকমত্য কমিশনের বাইরে গিয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইছে।
বিএনপি এ বিষয়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
গত ১৭ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত “জুলাই সনদ”-এ সংস্কারের ৮৪টি প্রস্তাব রাখা হয়। এর মধ্যে পিআর পদ্ধতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ ১৫টি বিষয়ে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় খসড়ায় ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাব যুক্ত হয়েছে, যার ওপরই গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এই খসড়ায় ভিন্নমতের (নোট অব ডিসেন্ট) কোনো স্থান নেই।
বিএনপি এই পদক্ষেপকে ‘প্রতারণা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে নির্বাচনের দিনেই গণভোটের দাবি জানায়। অপরদিকে জামায়াত নভেম্বরে গণভোট চায়, তবে ভিন্নমতমুক্ত তপশিলের ভিত্তিতে। এনসিপিও একই অবস্থান নিয়েছে।
রাজনৈতিক দলের এই মতবিরোধ কমাতে পাঁচজন উপদেষ্টাকে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা সন্তোষজনক অগ্রগতি আনতে পারেননি। ফলে উপদেষ্টারা এখন সিদ্ধান্তের ভার দলগুলোর ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন।
একজন উপদেষ্টা মন্তব্য করেন, “সব দলই ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের অংশীদার, কিন্তু এখন পারস্পরিক সন্দেহ আর জেদের কারণে তারা ছাড় দিতে পারছে না। তাই আলোচনার জন্য অতিরিক্ত এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে, যেন সমঝোতার সুযোগ তৈরি হয়।”